
হেফজখানার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় শুনতাম মধুমাখা সাবলীল কোরআন তেলাওয়াত চলছে। ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া আজিজিয়া বাহিরদিয়া মাদরাসায় তখন মক্তব বিভাগে পড়ি। কিছুদিন পরে মক্তব শেষ করে জেলার কোন্দারদিয়া মাদরাসায় হেফজখানায় ভর্তি হই। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক হাফেজ আনোয়ার হুসাইন বললেন,হিফজ নেওয়ার আগে তোমাকে কিছুদিন মশক করে তেলাওয়াতের মানটা আরো সুন্দর করতে হবে। এই বলে তিনি টেপরেকর্ডার চালিয়ে সেই সাবলীল তেলাওয়াত অনুসরণ করতে বললেন যা ছোট বেলায় হেফজখানায় শুনতাম। তাই অবসর পেলেই কারী সিদ্দিক আল-মিনশাবীর তেলাওয়াত চালু করে মশক করতাম। আর সেই থেকে কতবার যে কারী মিনশাবীর নাম আর তেলাওয়াত শুনেছি তা বলে শেষ করা যাবে না।ভাবতাম কারী সাহেবের বাড়ি বাংলাদেশে, কোনদিন হয়তো উনার সোহবত পাবো। কিন্তু যখন শুনলাম তিনি মিসরীয় এবং বাংলাদেশ জন্ম হওয়ার আগেই উনি ইন্তেকাল করেছেন তখন থেকে আমার ক্ষুদ্র মনে কৌতূহল সৃষ্টি হলো যে, একজন মৃত্যুপ্রাণ মানুষ কিভাবে এতো সুন্দর করে জীবনীসঞ্চার তেলাওয়াত করতে পারে। আর সেই থেকে তাঁর ব্যাপারে জানার আগ্রহ ছিলো, তবে কেন যেন জানা হয়ে উঠেনি।
গত ২০ জানুয়ারি আল-জাজিরাতে দেখি কারী সিদ্দিক আল-মিনশাবীকে নিয়ে নাতিদীর্ঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেদিন ছিলো তার জন্মশতবার্ষিকী; তার মানে কারী সাহেবের জন্ম হয়েছিলো ১৯১৯ বা ১৯২০ সালের ২০ জানুয়ারি।
ঐ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কোরআনে কারীম তেলাওয়াতে অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখা মহান এই মনিষী মাত্র ৮ বছর বয়সেই হিফজ সম্পন্ন করে ফেলেন। অতঃপর কোরআনে উচ্চতর গবেষণা করার জন্য ভর্তি হন ঐতিহাসিক আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আল-জাজিরা সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে যে কথাটি বলতে চেয়েছে তা হলো, ক্বারী সিদ্দিক আল-মিনশাবীর নিজের প্রচারবিমুখতা। ছাত্র বয়সেই সুন্দর তেলাওয়াত করে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন-এজন্য সবখানেই তাকে নিয়ে আলোচনা চলতো এবং গোটা মিসরে তার প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়েছিলো ছোট্ট সময়েই কিন্তু তিনি এটা পছন্দ করতেননা। বলা যায় ঘরকুনো কিসিমের মানুষ ছিলেন তিনি। কারী মিনশাবীর নিজেকে গুটিয়ে রাখার ব্যাপারটি এতই ভয়ানক রূপ ধারণ করেছিলো যে, আজ আমরা টেপরেকর্ডারের কল্যাণে তার ধীরপ্রশান্ত কন্ঠে যে মধুময় তেলাওয়াত শুনি এটা তিনি করতে চেয়েছিলেন না।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, মিসর সরকার উদ্যোগ নিয়েছিলো কারী সিদ্দিক আল-মিনশাবীর কোরআনের ৩০ পারার সম্পূর্ণ তেলাওয়াত রেকর্ড করবে, এজন্য তাকে বেতার ভবনে আমন্ত্রণ জানানো হয় কিন্তু পরক্ষণেই কারী সাহেব বেতারে যেতে অস্বীকৃতি জানান। পরে বাধ্য হয়ে সরকারের নির্দেশে বেতার কর্তৃপক্ষ কারী মিনশাবীর বাড়িতে আসে এবং কোন এক রমজানে কারী সাহেব দৈনন্দিন যে তেলাওয়াত করতেন সেটাই বেতারের পক্ষ থেকে রেকর্ড করা হয়-তার পরের ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। কারী সাহেবের জীবদ্দশায়-ই তিনি এই রেকর্ডের ফল পেতে শুরু করেন। রেকর্ড মারফত সারা বিশ্বে তার তেলাওয়াত ছড়িয়ে পড়লে তিনি আর ঘরে থাকতে পারেননি, পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে তিনি অভিনন্দিত হতে থাকেন। একেককরে তিনি আমন্ত্রিত হন পবিত্র শহর আল-কুদসের আল-আকসায়, কুয়েত, লিবিয়া, আলজেরিয়া, ইরাক, সৌদিআরব এবং বৃটেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সহজ ও সাবলীলতার সাথে কোরআন তেলাওয়াতের স্বীকৃতি স্বরূপ সিরিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া ক্বারী সিদ্দিক আল-মিনশাবীকে বিশেষ সম্মাননা স্মারক প্রদান করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তার তেলাওয়াতের মূল বৈশিষ্ট্য ছিলো- মাখরাজের পূর্ণ অনুস্মরণ, স্পষ্ট উচ্চারণ ও খোলা আওয়াজ। এই অনন্য গুণের জন্যই তিনি সর্বজনপ্রিয় ও বিশ্ববিখ্যাত হতে পেরেছিলেন।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনটি শেষ হয় আর কারী সিদ্দিক আল-মিনশাবীর বিস্ময়কর প্রতিভায় আমি পুলকিত হই। এমন সময় আল-জাজিরার প্রতিবেদনে দেখি তার অসুস্থতা ও ইন্তেকালের কথা-১৯৬৬ সালে তার কণ্ঠনালীতে ইসোপাজিয়াল ভাইরাস (টিউমার জাতীয় ব্যাধি) ধরা পড়ে। তবুও তিনি ক্ষান্ত হননি কুরআনের তেলাওয়াত থেকে। কয়েকবছর এই ব্যাধিতে ভুগে অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২০ এপ্রিল কুরআনের এই মহান খাদেম পার্থিব মোহ-মায়া ত্যাগ করে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে গমন করেন। আর আমাদের মাঝে রেখে যান তার অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর কোরআনে কারীমের পূর্ণ ৩০ পারা তেলাওয়াতের টেপরেকর্ড। যার মাধ্যমে আজও তিনি বেঁচে আছেন পৃথিবীর অসংখ্য কোরআন-প্রেমিক মানুষের হৃদয়ে।
